চৈত্রের এক অলস দুপুরে খাটে উপুর হয়ে শুয়ে জানালার কাছের আম গাছের মুকুল কটা এলো সেটা গুনছিল মেয়েটা। কালকে তার পরীক্ষা শেষ, এরপর বেশ অনেক দিনের লম্বা একটা ছুটি পাবে সে। বহু আকাঙ্ক্ষিত ছুটি এটা। গত একটা বছর নাক মুখ গুঁজে পড়তে পড়তে হাপিয়ে গেছে সে। বাসা থেকে একদম কড়া নজরদারী চলেছে, যাতে একটুও ফাঁকি সে না দিতে পারে। গানের স্কুলে যাওয়া বারণ, টিভি দেখা বারণ, পাশের বাসায় ঘুরতে যাওয়া বারণ, ছাদে বেশী হাঁটাহাঁটি করা বারণ - দিন রাত শুধু পড়া আর পড়া। এমন অসহ্য বিভীষিকাময় বছর যেন কারো শত্রুর জীবনেও না আসে। তবে এই তো আর একটা দিন। এরপর সে প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াবে, যেখানে খুশী সেখানে। আম-পুকুরে ভেসে থাকবে সারাদিন। কালুয়া গরুর যে মিষ্টি দেখতে একটা বাছুর হয়েছে, সেটার সাথে খেলবে ইচ্ছা মত। আর এক বছরে যত গুলো নতুন সিনেমা এসেছে, সবই তো তার কালকে এসেই দেখে ফেলা চাই। আর, হয়তো তার সাথেও দেখা হয়ে যেতে পারে। সেই যে আর্ট কলেজে গেল পড়তে, আর তো দেখা হল না। এই গরমের ছুটিতে আম কাঁঠাল খেতে যদি বা সে আসে! চৈত্রের উতল হাওয়ায় মনটা কেমন হু হু করে ওঠে মেয়েটার। এত আনন্দের মাঝেও কেমন যেন বিষন্ন লাগে তার। টেবিলে গিয়ে খোলা বইটার সামনে বসে পৃষ্ঠা গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু মন পড়ে থাকে জানালার বাইরে, ওই কালো জলের গভীরতার ভিতর। সেই জলের বুক চিড়ে কতই না এপাড় ওপাড় করতো সে। সেই পুকুর পাড়েই ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা। কতই না বকাবকি করেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। একটা প্রত্যুত্তরো করে নি ছেলেটা, শুধু মাথা নিচু করে থেকেছে। সহসা মেয়েটার চোখে পড়ে পুকুর পাড়ের নরম মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁকা একটা মুখ, অবিকল তার মত! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সে। সেই শেষ দেখা ছেলেটার সাথে। পরে মার কাছে শুনেছে, পাশের বাসার নতুন বাসিন্দাদের ছেলে নাকি ভারী সুন্দর ছবি আঁকে, আর্ট কলেজে পড়ে। দুইদিনের ছুটিতে এসেছিল, আবার চলে গেছে। মেয়েটার মনে পড়ে ছেলেটার গভীর চোখ দুটোর কথা। অন্যায় সে অবশ্যই করেছে, লুকিয়ে লুকিয়ে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে। তাও কেন যেন আবার একটু দেখতে মন চায় মানুষটাকে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে তার সাথে। বইয়ের ভিতর মাথা গুঁজে চোখ বন্ধ করে মেয়েটা। আর তো একটা দিন, তারপরই ছুটি।
_
একটা রোগা মত ছেলে, বসে আছে পুকুর পাড়ে, সামনে তার আঁকার খাতা। চোখ বুজে ছেলেটা কি যেন ভেবেই যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। খাতার পাতাটা ফাঁকা পড়ে আছে, রঙ তুলিও পরে আছে অধরা। পুকুরের সুন্দর টলটলে কালো জলে আম বনের ছায়া পড়েছে। জলার ধারের আম গাছের ডাল বড় বড় আমে ভারী হয়ে নুয়ে পড়েছে পুকুরের জলের দিকে। যেন কেউ জলের ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে টুকুস করে আমটা পেড়ে নিবে এক্ষুনি। পুকুর পাড়ের শীতল আমেজে জৈষ্ঠের গরম অনেকটাই গা সয়া হয়ে গেছে। ভর দুপুর বেলা, কোথাও কেউ নেই। ছেলেটা যেন এই শান্ত পরিবেশে বসে ধ্যান করছে। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে পুকুরের জলে আলোড়নের শব্দ ওঠে। ছেলেটাও সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়। আর মাটি থেকে তুলে নেয় তার আঁকার সরঞ্জাম। তুলির অদ্ভুত ক্ষীপ্র টানে সেই সাদা কাগজে সে ফুটিয়ে তুলতে থাকে একটা ছবি, যে ছবিকে ধরার জন্য তার এই ধ্যান, একাগ্রতা। আস্তে আস্তে জলের আলোড়ন থেমে আসে। একটা ভেজা গামছা গায়ে জড়িয়ে মেয়েটা আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায় ওই পুরোনো গোছের দালানটার দিকে। পুকুরের অন্য পাড়ে বসে ছেলেটা তাকিয়ে থাকে মেয়েটার যাবার পথের দিকে। এরপর ধীরে ধীরে তার আঁকার সরঞ্জাম গুছিয়ে সেও চলে যায়। শুরু হয় আরেকটা দিন শেষ হবার প্রতীক্ষা, আরেকটা দুপুরের প্রতীক্ষা।
_
গভীর রাতে যখন বাসার সবাই ঘুমিয়ে, তখন মা টা চুপি চুপি ছেলেটার ঘরে ঢোকে। আঁচল দিয়ে প্রদীপটা আড়াল করে রাখে, যেন ছেলের চোখে আলো না পড়ে। আস্তে আস্তে টেবিলের কাছে গিয়ে প্রদীপটা রাখে। এইতো, টেবিলের উপরই সেই আঁকার খাতা। ধীরে ধীরে খাতাটা খোলে মা, আস্তে আস্তে পাতা উল্টায়। খুব সাবধানে হাতের তেলোয় মুছে ফেলে গালে গড়িয়ে যাওয়া চোখের জলটাকে। তারপর অতি সন্তর্পনে খাতাটা জায়গায় রেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে মা। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে শ্রাবণের ভেজা বাতাসে মিলিয়ে যায়।
_
সকাল থেকে হৈ হট্টোগোলে বাসাটা ভরে আছে। খুব হুলু স্থুল চলছে চারিদিকে। বড় বড় মাছ কাটা হচ্ছে এক দিকে, অন্য দিকে ডাই করা সবজির স্তুপ। গ্রামের ছেলে পুলেরা যখন তখন উঁকি দিচ্ছে, বড়দের ধমক খেয়ে পালাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে সাথে সাথেই। হাজারটা নিয়ম আর কানুনের ঠেলায় দম নিতে পারছে না ঘরের মানুষ গুলো। তবে, একটু পিছনের, ওই পুকুরের কাছের ছোট ঘরটাতে সেই হট্টগোলের ছোঁয়া আসছে না তেমন। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো একটা ঘর। জানালার পাশে একটা ছোট খাট, সেই খাটের পিছনে আলনায় পাট পাট করে সাজানো কিছু জামা। জানালার উলটো দিকের দেয়ালে ঝুলছে একটা আয়না। তার পাশে একটা পড়ার টেবিলে সাজানো অনেক অনেক বই। পাশের ফাঁকা দেওয়ালে ঝুলছে একটা সার্টিফিকেট, কৃতিত্ত্বের সাথে মেট্রিক পরীক্ষা পাসের জয়বার্তা জ্ঞাপক। তার একটু উপরে একটা ছবিতে মেয়েটা হাসছে। চৈত্রের মাতাল হাওয়ায় দুলে দুলে উঠছে ছবির উপরের মালাটা। এক বছর আগে পরীক্ষা দিয়ে মেয়েটা আর ঘরে ফেরেনি। একটা দুরন্ত গাড়ির নিচে চাপা পরে মরে গেছে মেয়েটার ইচ্ছে গুলো।
০৩/১০/২০২২
ডালাস