অধর বাবু দোকানের হিসাবের বই এর হিসাব চুকিয়ে, বাতি নিভিয়ে, দোকানের শাটার যখন লাগালেন, তখন দোকানের ঘড়িতে রাত তিনটা বেজে গেছে। অধর বাবুর বাসায় সেদিন মঙ্গল চন্ডীর পূজা ছিল। সেখানে দোকানের কর্মচারীদের নিমন্ত্রণ ছিল। তাদের সাথে বাসায় গিয়ে পূজার কর্তব্য পালন করে একলাই ফিরেছিলেন দোকানের হিসাব মিটাতে। কর্মচারীদের সেদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন। কদিন আগেই ছোট ঈদের জন্য মাস ব্যাপী অনেক বিক্রি বাট্টা হয়েছে, রমজানের শেষের কয় রাত দোকানেই থাকতে হয়েছে কর্মচারীদের। সেই খাটাখাটনির একটা ছোট খাট পুরষ্কারস্বরূপ আজকের দিনটা আধাবেলা ছুটিই পেল সবাই। অবশ্য, সপ্তাহের মধ্যে তো দোকান বন্ধ করে রাখা যায় না। কোন কাস্টমারের কি দরকার পরে, বন্ধ দুয়ার দেখে ফিরে গেলে ব্যবসার অকল্যাণ হবে। তাই অধর বাবু নিজেই দোকানে ছিলেন রাত অবধি। এমন দুইটা তিনটা বাজিয়ে ঘরে ফেরাটাই অধর বাবুর পেশায় স্বাভাবিক, বাড়িতেও তাই মেনে নিয়েছে। নতুন নতুন বিয়ের পর অধর বাবুর ঘরণী রাত জেগে অপেক্ষায় থাকতেন। বছর ত্রিশেক সংসার করার মাঝে এই অপেক্ষাটুকুর হাল উনি ছেড়েই দিয়েছেন। তাকে উঠতে হয় ভোর রাতে, নিজ হাতে সংসারের সকল কাজ সামলাতে হয়। হয়তো উঠে তিনি দেখলেন, অধর বাবু মাত্র বাড়ি এলেন, এখন তিনি স্নান করে ঘুম দিবেন। অতএব, অধর বাবুর অপেক্ষায় ঘরে কেউ বসে থাকে না, এতে অধর বাবুরো বিন্দুমাত্র ক্লেশ নেই। তার কাছে বাইরের দরজার ডুপ্লিকেট চাবি আছে। কোন হাঁক ডাক না করেই নিশ্চিন্তে বাসায় প্রবেশ করতে পারেন তিনি।
অধর বাবুর বাসা দোকান থেকে হাঁটা ১০ মিনিট। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততম বাজারের মাঝা মাঝি বেশ সুবিধাজনক স্থানে উনার দোকান। তবে, তার কাছা কাছি বসত ভিটা পাওয়া যায় না। তাই বাসাটা সামান্য একটু দূরেই নিতে হল। কিন্তু ১০ মিনিট হাঁটা আর এমন কি। রাতের শুনশান রাস্তায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে নিতে বাসায় ফিরেন তিনি। প্রায়ই সাথে তার ম্যানেজার এবং কিছু কর্মচারীও বাসা পর্যন্ত আসে। তাদেরো বাসা কাছে পিঠেই। এমনকি একলা বাসায় ফিরতেও সমস্যা নেই। শহরটা বরাবরই শান্ত, শহরের ভিতর কোন খুন-খারাবী, লুঠতরাজের ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেছে বলে অধর বাবুর মনে পরে না।
তাই আজো দোকান বন্ধ করে গুণ গুণ করে গাইতে গাইতে অধর বাবু বাড়ির পথ ধরলেন। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। হেমন্তের রাত, হাল্কা একটু কুয়াশার মত পড়েছে। এটাকে অবশ্য কুয়াশা বলে না, ধোঁয়াশা বলে, চারিদিক একটু ধোঁয়া ধোঁয়া। একটু পরে, অধর বাবুর মনে হল, রাতটা আজকে বড্ড বেশী নির্জন। কারণ ঘাটতে গিয়ে লক্ষ করলেন, রাস্তার নেড়ী কুকুরগুলোকে আজ আর দেখা যাচ্ছে না। কানে আসছে না কোন শিয়ালের ডাকও। বাতাসো যেন বইছে না, গাছের পাতাও তাই একদম স্থির। অধর বাবু খুব একটা ভীতু মানুষ নন, কিন্তু এত নির্জনতায় উনার একটু একটু অস্বস্তি হতে লাগল। গলার স্বরটা একটু চড়িয়ে জোরে জোরেই গাইতে লাগলেন তিনি। এতে মনের অস্বস্তি ভাবটা যেন একটু একটু করে কাটতে লাগল।
দোকান ছেড়ে বড় রাস্তা বরাবর পূব দিকে কিছুটা আগানোর পর হাতের ডানে পরে আ* জামে মসজিদ। এর পাশের মাঝারি আকারে রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হেঁটে বা দিকের দুই নম্বর গলিতে ঢুকতে হয়। সেই গলির মুখে ইদানিং এক কোচিং সেন্টার খুলেছে, তার পোস্টারে পোস্টারে দুইদিকের দেয়াল ভরা। গলি দিয়ে কিছু দূর গেলে মেজো বাড়ির পুকুর পরে ডান দিকে। আরো কিছুদূর এগোলে পরে রেল লাইন। সেই রেল লাইন পার হয়ে বাঁ দিক বরাবর একটু হাঁটলেই অধর বাবুর দোতলা বাড়ি চোখে পরে। অধর বাবু হাঁটতে হাঁটতে কোচিং এর গলির মুখে পৌঁছলেন। উনার মেজো কন্যার এবার পরীক্ষার ফলাফল খুব একটা সুবিধার হয় নি। কোচিং এর পোস্টার গুলোর অবয়ব চোখে পরা মনে মনে ভাবলেন, একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন কোচিংটি কেমন। এইসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছেন। হঠাৎ তার মনে হল, কই, মেজো বাড়ির পুকুরটাতো চোখে পরল না। এত বড় পুকুর, পাশ দিয়ে গেলেই পুকুরের জলীয় বাষ্প পূর্ণ বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। এতটাই আত্মমগ্ন উনি যে খেয়ালই করলেন না কখন পুকুর পার হয়ে চলে গেলেন। কিন্তু, এতো সেই গলি নয়। জমির বাবুর বাউন্ডারির দেওয়ালটা তো চোখে পরছে না। তাহলে কি মনের ভুলে ভুল রাস্তায় চলে এলেন। এইসব ভাবতে ভাবতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ তার মনে হল, পিছনে একটা পদক্ষেপ যেন তার কানে এল। অধর বাবুর শিড়দাড়া বরাবর একটা ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল। ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরালেন তিনি। নিয়ন বাতির আলোয় ধোঁয়াশার উপর পরে একটা আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি করেছে। সেই আবছা আলোয় কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না তার পিছনে। পিছনে ফিরলেন যখন, ভাবলেন, ফিরে গিয়ে আবার মসজিদ রোডে উঠবেন। তারপর ধীরে সুস্থে রাস্তা চিনে চিনে হাঁটবেন। ফুরফুরে গলায় গান গাইছেন, হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছেন অধর বাবু। কিন্তু মনের একদম পিছনে একটা কাঁটার মত চিন্তা বিঁধছে। এপথে কত বার দোকান থেকে বাসা আর বাসা থেকে দোকান গিয়েছেন। কই, প্রবল ঘুমের ঘোরেও একবারো তো এমনটা হয় নি। তবে আজ কি হল? কেনই বা অস্বস্তি লাগছে। গানের সুরে এই চিন্তা গুলোকে জোর করে চাপা দিতে লাগলেন অধর বাবু। দেখতে দেখতে মসজিদ রোডে ফিরলেন। দেখলেন, ভুল করে কোচিং এর গলিতে না ঢুকে উনি তার উলটো দিকের গলিতে ঢুকে গিয়েছিলেন। মনে মনে হাসলেন। বয়স হয়েছে, এ তারই প্রমাণ। তবে এবার আর ভুল হবে না, ভেবে পা চালালেন কোচিং এর গলির ভিতর।
প্রবল উদ্যোমের সাথে হাঁটছেন। হাঁটছেন তো হাঁটছেনই, পথ যেন আর ফুরোয় না। কই মেজো বাড়ির পুকুর, কই জমির বাবুর বাউন্ডারি, এ কোন রাস্তায় হাঁটছেন তিনি? চাপা দেওয়া অস্বস্তি আর ভয় গুলো নানা ফাঁক দিকে গলিয়ে বের হয়ে অধর বাবুকে ঘিরে ধরতে আরম্ভ করল। একটু শান্ত হয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবার জন্য অধর বাবু দাঁড়ালেন। এবং আবার যেন শুনতে পেলেন, একটা পদক্ষেপের শব্দ।
ঝট করে পিছনে তাকালেন অধর বাবু। কই, কেউ নেই তো? এবার সামনের দিকে তাকিয়ে কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। আবার সেই একটা অতিরিক্ত পায়ের শব্দ! কে? কে মস্করা করছে এই রাত বিরেতে? কার এত বড় স্পর্ধা! এবার রাগ দিয়ে ভয়কে ঢাকার চেষ্টা করলেন অধর বাবু। কটমট করে চাইলেন পিছনে। সোজা রাস্তা পিছনে, মিলিয়ে গেছে ধোঁয়াশায়, এত তাড়াতাড়ি কেউ লুকিয়ে পড়বে তেমনটা হওয়ার কথা নয়। ঢোক গিললেন অধর বাবু। এই মৃদু শীতের রাতেও ঘামে তার শার্টের পিঠ ভিজে গেছে। না, ভয় পাওয়া চলবে না। আবার ফিরতি পথে হেঁটে মসজিদ রোডে এসে পৌঁছালেন অধর বাবু। একবার ভাবলেন, আচ্ছা, বাড়ি যখন যেতে পারছিই না, দোকানেই ফিরে যাই। এমন ভেবে উনি বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু কোথায় সে বড় রাস্তা? মসজিদ রোডের যেন কোন শেষ নেই। অধর বাবু প্রমাদ গুণলেন। তবে কি ভুল দিকে হাঁটছেন তিনি। আর যতবারই থেমে যাচ্ছেন, পিছনে সেই একই পদক্ষেপের শব্দ। প্রথমে যা কিছুটা অস্পষ্ট ছিল, ধীরে ধীরে তার স্পষ্টতা যেন বাড়ছে। দিক পালটে উলটো দিকে হাঁটা দিলেন। হ্যাঁ, এই যে কোচিং এর গলি, এই যে ননীগোপালের মিষ্টান্ন ভান্ডার, এই যে কাদের শু স্টোর এর পরেই তো মসজিদটা চোখে পরবে নাকি? চারিদিকের ধোঁয়া ধীরে ধীরে বাড়ছে, সেই ধোঁয়ার আড়ালে ঢাকা পরে গেছে মসজিদ। অধর বাবু লক্ষ্য করলেন, তার হাত কাঁপছে। কোন ক্রমে পাশে ফুটপাতের উপর বসে পড়লেন। ভাবলেন, ফুটপাথে বসেই রাতটা পাড় করে দিবেন। রাত আর কতই বা বাকি! এই ভেবে সময় দেখার জন্য হাতের ঘড়ির দিকে চাইলেন অধর বাবু। রাস্তার অস্পষ্ট আলোয় দেখলেন, ঘড়ির কাঁটা বলছে, রাত তিনটা বাজে। আঁতকে উঠলেন অধর বাবু। উনার স্পষ্ট মনে আছে, দোকান থেকে বের হওয়ার সময় দোকানের ঘড়িতে তিনটা বেজেছিল। এরপরে উনি কমে করে হলে আধা ঘন্টা যাবত হাঁটছেন। তবে কি ঘড়ি নষ্ট হয়ে গেল? কই, সেকেন্ডের কাটা তো ঘুরছে ঠিকই। তবে কি হাতের ঘড়ি কোন কারণে স্লো হয়ে গিয়েছিল? জোরে জোরে শ্বাস ফেললেন অধর বাবু। জোরে জোরে শ্বাস ফেললে ভয় কেটে যায়। ভাবলেন, একটু সময় বসাই যাক। আন্দাজ মনে মিনিট পাঁচেক পর আবার ঘড়ি দিকে তাকালেন। সেই তিনটাই বাজে। ঘড়িটাই তাহলে গেছে মনে হয়। এদিকে ধোঁয়াশার কারণে সব কেমন আবছা আবছা হয়ে গেছে। বছরের এই সময় এত ধোঁয়াশা কেন? দূরে মনে হল যেন একটা আলো সরে সরে যাচ্ছে। অধর বাবুর মনে হল, ওটা একটা রিক্সার আলো। হ্যাঁ, একটা রিক্সা পেলে সমস্যার সমাধান হয়। উঠে সেই আলোর দিকে হাঁটতে লাগলেন, আর জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলেন, এই রিক্সা, দাঁড়াও। কিন্তু সেই আলোর থামার কোন নাম গন্ধই নেই। আস্তে আস্তে যেন তার সরে যাওয়ার বেগ বাড়ছে। অধর বাবু দৌড়াতে থাকলেন, কিন্তু সেই আলো ধরতে পারলেন না। থামার সাথে সাথেই তার একদম কানের কাছে একটা অতিরিক্ত পদক্ষেপের শব্দ এলো। অধর বাবু সারা শরীর কাঁপছিল। উনি ভাবলেন, আবার সেই ফুটপাথেই বসা যাক। কিন্তু কই সেই ফুটপাথ। চারিদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া, নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পারছিলেন না তিনি। তাও একপা আগালেন। গিয়ে থেমে গেলেন। সেই পায়ের শব্দও এলো পিছু পিছু।
ভোরে ঝাড়ুদার এসে দেখতে পেল, অধর এন্ড সন্স এর শাটারের সামনে কে যেন পড়ে আছে। ঝাড়ুদারের চিৎকারে আশে পাশের কিছু মানুষ এসে জড় হল। জড় হওয়া লোকের মাঝে একজন বলে উঠল, আরে, এ অধর বাবু না? সবাই গোল হয়ে দেখতে লাগল, এই অদ্ভুত দৃশ্য! অধর বাবু রাস্তায় পরে আছেন ঠিকই, কিন্তু তার পা যেন শূণ্যে এক কদম আগিয়ে দেওয়া। আর দুই হাত আকাশের দিকে। প্রাণহীন বড় বড় দুই চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি, সেই চোখে অসীম আতঙ্ক!
১২/০৩/২০২০
কলেজ স্টেশন