“আপা! ভালা আছেন?”
চমকে মাথা তুলে তাকায় তুলি। আজকে তার গণিত পরীক্ষা। অংক কষতে তার যতই ভালো লাগুক, পরীক্ষার হলে গিয়ে যোগের বদলে বিয়োগ, আর ভাগের বদলে গুণ করে অংক ভুল করার এত বেশী রেকর্ড করে ফেলেছে যে গণিত পরীক্ষাকে এখন সে ভয় পায় সবচে বেশী। বেশ অন্য মনস্ক হয়েই মাথা নিচু করে হাঁটছিল সে। আনমনেই অভ্যাসবসত স্কুলের গেটে বসা ভিক্ষুককে দুইটা টাকা দিয়ে ফেলে গেটের ভিতরে ঢুকতে যাবে, তখন কানে এলো এটা। একটু থতমত খেয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালো তুলি। ওই ভিক্ষুকটা, যাকে সে পরীক্ষা চলাকালীন প্রতিদিন দুটো টাকা দেয়, সে তার দিকে দাঁত বের করে হাসছে। দাঁত মাজে না লোকটা কতদিন কে জানে? দাঁত গুলো নোংরা হলুদ, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কালো মাড়িও দেখা যাচ্ছে। লোকটার চোখটা কেমন হলদে হলদে, মুখে অনেক ময়লা। একটা ছেড়া শার্ট পড়া, লুঙ্গিটা কতদিন কাঁচা হয় না কে জানে! তুলির হঠাৎ মনে হল, এই প্রথম যেন সে এই লোকটাকে দেখছে। অথচ এই লোক প্রতিদিনই এই জায়গাটাতে বসে। কোন এক পরীক্ষার দিন একে ভিক্ষা দিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়ার পর সেই দিনের পরীক্ষা খুব ভালো হয়। এরপর থেকে সব পরীক্ষার সময় তুলি একে দুটো টাকা দেয়। শুধু সেই না, আরো অনেকেই টাকা দেয়। এই লোকটা একটা অদ্ভুত গান গেয়ে সেই টাকার জন্য দোয়াও দেয়। কিন্তু, কখনো তো তাকে এই রকম স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে শুনে নাই সে? সে যে একটা স্বাভাবিক মানুষের মত কথা বলতে পারে, অথবা তাকে চিনে রাখতে পারে- এটা কল্পনাতেও আসে নি তুলির। খুব অপ্রস্তুত হয়ে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ না কিছু একটা বুঝিয়ে গেটের ভিতর ঢুকে যায় তুলি। ওর কানটা গরম হয়ে গেছে।
পরীক্ষাটা কোন রকম হয়েছে। বুদ্ধি করে সব গুলো “প্রমাণ কর” ধরণের অংক কষেছে তুলি। তবে, পরিসংখ্যানের অংকটাতে গড়ের উত্তর ওর এসেছে ১০২, যেখানে অন্যদের ৯০। কিছু যদি পার্শিয়াল মার্ক না দেয়, তাহলে ১০ টা নাম্বার গেল। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে এসেছে তুলি। গণিত পরীক্ষাটাই শেষ পরীক্ষা ছিল। আসলে হরতালের কারণে এটা পিছিয়ে সবার শেষে পরেছে, নইলে আরো দুই দিন আগেই পরীক্ষা শেষ হবার কথা। পরীক্ষা শেষের আনন্দই আলাদা। বাকি সারাটা দিন অনেক মজা করে, রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় তুলির সকালের পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগের ঘটনাটা মনে পরল। পরীক্ষা শেষের উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিল ঘটনাটা। তুলি আপনমনেই ভাবতে লাগল, আচ্ছা, এই ভিক্ষুকটা আমাকে কেন চিনে রেখেছে? এত এত মানুষ ভিক্ষা দেয়, তাহলে সে আমাকে চিনল কিভাবে? আমি কি দেখতে খুব সুন্দর? নাহ! ভারী অদ্ভুত বিষয় তো! আচ্ছা, সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল আমি কেমন আছি! কৈ আমি তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম না যে সে কেমন আছে? এটা কেমন অভদ্রতা হয়ে গেল না? ঈশ, কাল থেকে তো এক মাসের ছুটি। ঠিক আছে, ছুটি শেষ হলে আবার যখন দেখা হবে, তখন জিজ্ঞাসা করব, “আপনি কেমন আছেন?” আর এটাও জিজ্ঞাসা করব, কেন সে আমাকে চিনে রেখেছে। তাহলেই তো হল।
এক মাসের ছুটি কোথায় যে উড়ে গেল, বোঝার আগেই আবার স্কুল খুলে গেল। স্কুল খুললে বন্ধুদের সাথে দেখা হবে, সেটা যেমন মজা; আবার সারাদিন স্কুলে আটকা থাকতে হবে, সেটা খুব একটা সুখের কিছু না। স্কুল খোলার পর সপ্তাহ খানেক কেটেও গেছে। ছুটির দিনে দুপুরে তুলি শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল, তখন বাসার গেটে এক ভিক্ষুক কড়া নাড়ল গান গাইতে গাইতে। তখনই তুলির মনে পরে গেল সেই স্কুলের সামনের ভিক্ষুকের কথা, তুলির যে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আছে- সে সব কথা। বেমালুম মাথা থেকে উড়ে গেছে পুরো ঘটনাটা। পরক্ষণেই মনে হল, স্কুল খোলার পর সেই ভিক্ষুককে তো আর চোখে পরে নি। সে যেখানে বসে, সেই জায়গাটা একদম খালি। সেই পরিচিত সুরের গান গত সপ্তাহে একদিনো শুনেছে বলে মনে পড়ল না। নাকি সে খেয়াল করে নি? পরের দিন স্কুলে ঢোকার আগে গেটের ধারে কাছে সেই ভিক্ষুককে তুলি অনেকক্ষণ খুঁজল, খুঁজল স্কুল শেষে বের হওয়ার সময়ও। কিন্তু, তাকে কোথাও দেখল না সে। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করায় দারোয়ান জানালো, হেডমিস্ট্রেস বলেছে, স্কুলের সামনে ভিক্ষুক থাকাটা ভালো দেখায় না। তাই তাকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনে তুলির একটু যেন খারাপ লাগল। অবশ্য, সেটা বেশীক্ষণ থাকল না। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতল গভীরে হারিয়ে গেল এই ছোট ঘটনাটা।
এরপর অনেকটা দিন কেটে গেছে। তুলি এখন মেডিকেলে ইন্টার্ন করছে। সারাক্ষণ ডিউটির দৌড়া দৌড়িতে দিন যে কোথায় চলে যায়, টেরই পায় না। এত খাটাখাটনির পরেও মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে বলে রুগীদের মধ্যে তুলির বেশ জনপ্রিয়তা আছে। আর সেই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ওর ঘাড়ে ক্লাসমেটরা এটা ওটা চাপিয়ে দিতেও পিছপা হয় না।
এরকমই চলছিল দিনকাল। সেদিন রাতের মত তুলির ডিউটি শেষ। ক্যান্সার ওয়ার্ডের সামনে ঘুর ঘুর করছিল সে এক বন্ধুর অপেক্ষায়। তার সাথে এক সাথে হোস্টেলে ফেরত যাবে। ওয়ার্ডের বাইরেও কিছু রোগী চাদর পেতে শুয়েছিল, তাদের পাশে তুলি খুব সাবধানে পায়চারী করছিল, যাতে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। হঠাৎ তার কানে এলো, কাছ থেকে কেউ একজন খুব ক্ষীণ গলায় বলছেঃ
“আপা! ভালা আছেন?”
চমকে উঠলো তুলি। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজে পেল সেই কন্ঠস্বরের উৎসকে। হাসপাতালের ফ্লোরে করা একটা বিছানায় একদম মিশে আছে একটা শরীর। মানুষ বললে ভুল হয় যেন! কিন্তু সেই মানুষটার মুখের হাসিটা যেন তুলির খুব পরিচিত! কোথায় দেখেছে সে এই হাসি? ধীরে ধীরে তুলির স্মৃতির খুব গভীর থেকে হাচড়ে পাচড়ে উঠে এলো অনেক দিন আগের সেই অদ্ভুত সাক্ষাতের ছবিটা। সেই স্কুল গেটে ভিক্ষা করা ভিক্ষুক, যাকে সে হারিয়ে ফেলেছিল। আর কখনো সুযোগ পায় নি জিজ্ঞাসা করে উঠতে যে সে কেমন আছে, সে কেন তাকে মনে রেখেছে! স্বভাব সুলভ ভাবে তুলি একটু হেসে বলল
“ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
প্রত্যুত্তরে লোকটা একটু হাসল। তারপর বলল
“আপনার হাসিটা সেই একই রকম আছে”
বলেই লোকটার খুব কাশী শুরু হল। কাশতেও যেন খুব কষ্ট হচ্ছে লোকটার। লোকটা অবস্থা দেখে তুলির খুব খারাপ লাগল। কাছেই নার্সদের বসার ঘর থেকে নার্স কে ডেকে আনল সে। নার্স একটা ঘুমের ঔষধ দিয়ে হাই তুলতে তুলতে চলে গেল। এমন সময় পিছন থেকে তুলির বন্ধুর ডাকও এলো। বেশ অনেক রাত হয়ে গেছে, হোস্টেলে ফেরাটা জরুরি। লোকটাও কেমন ঘুমের ঔষধ পাওয়ার পর ঝিমিয়ে গেছে। তাই তুলি ভাবল, কালকে এসে আবার দেখে যাবে। যদি সে কোন সাহায্য করতে পারে!
পরেরদিন সকালের ক্লাস শেষ করে লোকটার কাছে যেতে যেতে তুলির বেশ অনেক দেরী হয়ে গেল। গিয়ে দেখল, কাল রাতে লোকটাকে যে জায়গায় পেয়েছিল সে, ওই জায়গাটা খালি। একটু খোঁজা খুঁজি করেও লোকটা্র হদিশ না পেয়ে যখন সে চলে যাচ্ছে, তখন দেখল আগের রাতের নার্স আবার ডিউটিতে এসেছে্ন। নার্সকে লোকটার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি জানালেন, ওই রুগী কালকে রাতে ঘুমের মধ্যেই মারা গেছে। সকালে রুগীর পরিবারের লোক এসে মরদেহ নিয়ে গেছে। তুলি দেখল, নার্সের চোখে কৌতূহল খেলা করছে! একটু বিব্রত হাসি হেসে তুলি পালালো নার্সের সামনে থেকে। একটু পরে তার নিজের ডিউটি শুরু, তার আগে কিছু একটা খাওয়া দরকার। ক্যান্টিনে গিয়ে দুইটা সিঙ্গারা নিয়ে এক কোণায় বসল তুলি। কিন্তু, খেতে পারল না একটা কামড়ও। একটা সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা, রাস্তার ভিক্ষুকের জন্য তার বুক ফেটে কান্না কেন আসছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু সে আজো পেল না!
০৩/২৮/২০২২
ডালাস