দূর্গামোহন চৌধুরীদের শহরের একদম কেন্দ্রে বিশাল পরিমাণ জায়গা। জমিদারের বংশধর চৌধুরীরা। খেটে বড় হওয়া রাম, ঘরে বসে খাওয়া রাম, এবং সব বেচে উদ্ধার হওয়া রামের বংশের শেষে এসে সেই বিশাল সম্পত্তির যে সামান্য অংশ বিশেষ চৌধুরীদের আছে, সেটাই থাকার ভাগ্য আজকাল খুব কম মানুষের থাকে। দূর্গামোহন বাবু বিচক্ষণ মানুষ, জমিদারীর জাতাভ্যিমান তার কোন কালেই খুব বেশী ছিল না। ব্যবসায় মাথা তাঁর বরাবরই ভালো ছিল। তাই সেই জমির সামনের দিকে সাড় করে গড়ে তুললেন বিপণি বিতান, আর পিছনে নিজেদের বসত ভিটা বানালেন। তদুপরি কিছু ভাড়া দেওয়ার জন্য ঘর বাড়ি তৈরি করলেন। সেই বিপণি বিতানের দুটি দোকান ঘরে দূর্গামোহন বাবু নিজের ব্যবসার পসার সাজিয়ে বসলেন। একটি হল সৌখিন প্রসাধন সামগ্রীর দোকান, আর অন্যটি স্বর্ণালংকারের। স্থান গুণে দুটি দোকানের বিক্রিই বেশ ভালো হচ্ছিল। ভাড়া দেওয়া দোকান গুলোরো পসার ভালো। দূর্গামোহন বাবু দুই দোকানের জন্য দিন ও রাতের দারোয়ান, কিছু কর্মচারী রেখে দিলেন, তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও দোকানের পিছনে তাদের বসত ভিটার একাংশে করে দিলেন। বেশ নির্ভরযোগ্য মানুষ, তাদের প্রাক্তন জমিদারীর প্রজাই এরা। তবে সেই জমিদারীর দিন তো আর নেই, তাই রাজা-প্রজা সম্পর্কের থেকে মনিব-কর্মচারী সম্পর্কটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূর্গামোহন বাবুর তিন ছেলে। বড় দুটির সাথে শেষটির ব্যবধান একটু বেশীই, যাকে বলে একদম শেষ বয়সের সন্তান। বড় দুটি বাবার আদর শাসন উভয়ই সমান ভাবে পেয়েছে, কিন্তু ছোটটির বেলায় দূর্গামোহনের শাসন করতে খুব বাঁধে। বয়সের সাথে সাথে মনের কোমলতা বাড়ে, তার উপর ছেলেটির মুখটা এত মায়া কাড়া। দুটো কড়া কথা শুনলে সেই মুখ কালো হয়ে যায়, তা দূর্গামোহনের সহ্য হয় না। বাবার আদরে আদরে ছোটটি ভারী দুষ্ট হয়ে উঠেছে, এবং ভীষণ সাহসীও। পোশাকী নাম ইন্দ্রজিৎ হলেও, বাসায় তাকে ছোটন বলে ডাকা হয়, বাজারে সে এই নামেই বেশী পরিচিত। এত দুষ্টুমির মাঝে ছোটনের একটি বিশেষ গুণ ছিল, সবাইকে সে খুব সহজেই আপন করে নিতে পারত। তাই হয়তো দোকানে গিয়ে চালের সাথে ডাল মিশিয়ে দিল, অথবা তেলের ডিবায় দুটো ফুটো করে দিল, কিংবা কারো বিক্রির জন্য বেঁধে রাখা মুর্গী ছেড়ে দিল, অথবা সদ্য সদ্য ভেজে রাখা দুটো ভাজা পোড়া টপ করে মুখে পুরে নিল- ইত্যাদি দস্যিপনার পরও সবাই ছোটনকে আদর করে। আর্থিক ক্ষতিগুলো অবশ্য দূর্গামোহনই সামলে নেন। আর ছোটনের প্রতি এই উদার পক্ষপাতিত্বের পিছনে যে দূর্গামোহনের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার তাগাদা একদমই নেই তাও বলা চলে না। তবুও ছোটনে মিষ্টি হাসি আর কাঁচা-মিঠা কথার কারণেও তার উপর রাগ করে থাকাটা খুবই দূরহ একটা কাজ।
দোকানের আধুনিকায়নের অংশ হিসাবে পুরো বিপনীবিতানকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হল। ফলস সিলিং বসিয়ে এয়ার ডাক্ট এর মাধ্যমে এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আইডিয়াটা শহরে বেশ নতুন। গরমে একটু এসির বাতাস খাওয়ার আগ্রহ অনেকেরই, সেই আগ্রহে দোকানে এসে হয়তো দু চারটা অযথা জিনিস কেনা কাটাও হয়ে যাচ্ছে, এভাবে করে দোকানের বিক্রি আরো বাড়ল। ব্যবসায় সাফল্যে দূর্গামোহন বাবুর মনে সব সময় একটি আনন্দের সুর বাজে। এই ব্যবসাকে আরো কিভাবে বাড়ানো সম্ভব এই ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে থাকলেন।
রাত আটটার দিকে মূলত বিপণী বিতানের বিপণ যজ্ঞের সমাপ্তি ঘটে। একে একে দোকানীরার তাদের দোকান গুছিয়ে বন্ধ করে নিজ নিজে বাড়িতে চলে যায়। রাতের পাহাড়াদার সামনে বসে ঝিমায়, আর তেমন কেউ দোকানের ভিতর থাকে না। একদিন এমন সাড়ে আটটা কি নয়টার দিকে জামিল সাহেব তার কাপড়ের দোকানটা গোছাচ্ছিলেন। দোকানে উনি ছাড়াও একটি কর্মচারী আছে, কিন্তু সে আজ তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়েছে। একা একা হিসাব মিলাতে মিলাতে একটু আধটু গরমিল হচ্ছিল, তাতে সময় লাগছিল অনেক। নানান রিসিপ্ট চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো খুঁজে পেতে হিসাব মিলানো একা একা একটু কঠিন, একটু বিরক্তিকরও। প্রায় শেষের দিকে একটা বেশ কয়েক হাজার টাকার হিসাব কিছুতেই মিলছিল না। জামিল সাহেবের হিসাব মিলাতে মিলাতে এমনি মাথা গরম, তারপর টাকার অংকটাও বেশ ভালো, সব মিলিয়ে খুবই বিরক্ত বোধ করছিলেন। এক আধবার কাউন্টারে অস্থির হয়ে বাড়ি দিলেন, নিজের মনেই বলে উঠলেন, শালার রিসিপ্টটা গেল কোথায়?
সেই সময় হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, বায়ের লাল খাতার ভিতরে সেই রিসিপ্ট। জামিল সাহেব সাত পাঁচ চিন্তা না করে তার বাঁ হাতের কাছের লাল খাতা খুলে দেখেন, আসলেই তো সেই রিসিপ্ট সেখানে। খুশী হয়ে হিসাব মিলাতে যাবেন, এমন সময় তার বোধদয় হল, কথাটা কে বলল? ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলেন, আশে পাশের সব দোকান বন্ধ, কোন মানুষ চোখে পড়ে না। জামিল বাবুর একটু ভয় ভয় লাগতে থাকল। গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, কে রে কথা বললি? তখন কে যেন খোনা গলায় বলে উঠল, তোর বাপ!
অমনি জামিল সাহেব ‘আল্লাগো’ বলে এক চিৎকার মেরে দোকান টোকান সব ফেলে দৌড় দিয়ে একদম বিপণী বিতানের সামনের সদর রাস্তায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে দারোয়ান তার এক ইয়ারের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মস্করা করছিল। জামিল সাহেবের ভূতে ধরা চেহারা দেখে সেও ঘাবড়ে গেল। হতভম্বের মত তাকে তার কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করল। জামিল সাহেব দোকানের দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভূত! শুনেতো দারোয়ান নিজেও এক লাফের রাস্তার মাঝে এসে দাঁড়ালো। তখন রাস্তায় রিক্সা চলছিল, আশে পাশে কিছু মানুষও ছিল। তারা আগ্রহ নিয়ে জানতে এল, ব্যাপারটা কি। তখন জামিল সাহেবে এলোমেলো ভাবে কিছুটা যা ঘটেছে, কিছুটা যা তার মনে হয়েছে মিলিয়ে একটা ভজঘট কাহিনী সবাইকে শুনাল। যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের অনেকেই শুনে হেসে খুন। নির্ঘাৎ কেউ জামিল সাহেবের সাথে মস্করা করে এমনটা করেছে। উনি যে একটু ভীরু প্রকৃতির মানুষ, তা অনেকেই জানে। আর ছোট শহরে এমন ধরণের কথা খুব সহজেই ছড়িয়ে যায়। তারপর সবাই জামিল সাহেবের দোকানে গেল, আশেপাশে কিছু দূর খোঁজা খুঁজিও করল। এদিকে মানুষের ভীড়ে ভিতর থেকে জামিল সাহেবেরো মনে সাহস হল। যদিও ওই বিপণি বিতান থেকে কাউকে কেউ বের হতে দেখে নি, তাও সবাই মনে মনে ধরেই নিল, এটা কারো দুষ্টুমি।
এরপর বেশ কিছুদিন নিরুপদ্রবই কাটল। এই ছোট্ট ঘটনাটাও কারো তেমন একটা মনে নেই। আবার ভূতের বদনাম হলে ব্যবসা খারাপ হবে কিছুটা ইচ্ছা করেই চাপা দেওয়া হয়েছে। সেদিন সারা শহরে সারদিন কারেন্ট নেই। ইলেক্ট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন অফিসে ট্রান্সফর্মারে আগুন লেগে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কারেন্ট আসা সম্ভাবনাও বেশ কম। বিপণি বিতানে ব্যবহৃত জেনারেটর টাও সারাদিন অনেক খেটেছে, তাই সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করার ঘন্টা খানেক আগে তাকে রেহাই দেওয়া হল। মোমবাতি জ্বালিয়ে দোকানের কাজ সারছিল আব্দুল জব্বার মিঞা। হঠাৎ করে কোথা থেকে যে দমকা হাওয়া এলো, আর মোমবাতির আলো নিভে গেল। দোকানের কর্মচারী সুকুর হোসেন তাড়াতাড়ি করে আবার মোমবাতি জ্বালালো। কিন্তু আবার তা নিভে গেল। কিছুটা ভয় পেয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বালালো সুকুর হোসেন। সেই টর্চের আলো দোকানের বিভিন্ন জায়গায় রাখা আয়ানায় প্রতিফলিত হয়ে একটু ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি করেছে। আব্দুল জব্বার মিঞার মনে পরে গেল কিছুদিন আগে জামিল সাহেবের বলা সেই কাহিনী। বিড়বিড় করে আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করল সে। কোন খারাপ জ্বিন থাকলে আশা করি আর তার কাছেও ঘেষার সাহস সে পাবে না। এমন সময় উপর থেকে খটাং করে একটা শব্দ হল, তারপর মনে হল, দোকানের ছাদ বুঝি ভেঙ্গে পড়ছে। পড়ি কি মরি ভাবে মিঞা ভাই আর সুকুর দোকান থেকে বের হল। তখন আশেপাশের কিছু দোকানে মানুষ ছিল। তারাও শুনতে পেরেছে সেই শব্দ। বিশাল গুঞ্জন শুরু হল চারিদিকে। সকলে বলা বলি করা শুরু করল, এ নিশ্চই অশরীরিদের কাজ কারবার। যে যেভাবে পারে দোকানের শাটার বন্ধ করে পালালো বিপণি ছেড়ে।
পরের দিন পুরো শহর রাষ্ট্র হয়ে গেল, দূর্গামোহনের দোকানে জ্বিনের আছর পড়েছে। মানুষ কেনা কাটা করতে আসবে কি, দোকানীরা দোকানই খুলতে চাচ্ছে না। দূর্গামোহন মনে মনে ভারী দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন। বেশ তো লাভের মুখ দেখছিলেন, কোথা থেকে কি হয়ে গেল! দোকানের একবার বদনাম হলে কি আর সেই দোকান চলবে? মানুষজন পরামর্শ দিল, ওঝা ডেকে এনে ঝাড়ফুঁক করাতে। দূর্গামোহন নিজেও যে খুব কুসংস্কার মুক্ত মানুষ ছিলেন, তা নয়! তার উপর, দোকানের পিছনেই তাদের বাসা। ভূত যদি দোকান ধরে, তাহলে বাসাতেও তার ঢুকতে কতক্ষণ। তাই খুঁজে পেতে নামকরা ওঝা ডাকালেন। তার উপর মসজিদের মৌলবীকে বললেন, কিছু উপায় করে জ্বিন তাড়ানোর। মন্দিরে পুরোহিতের কাছেও গেলেন, পাছে যদি ব্রহ্মদৈত্য দোকান ঘরে বাসা বাঁধে। ঝাড়ফুক, তাবিজ, পানি পড়া, শান্তি জল ছিটানো ইত্যাদির পর দোকানীরা সাহস করে দোকানে ফিরতে লাগল ঠিকই, কিন্তু বেচা কেনা ঠিক আগের মত জমল না।
শান্ত শিষ্ট মানুষটা ইদানীং যে খুব চিন্তা মগ্ন থাকে, তা ঘরের সবাইও বুঝতে পারছিল। তাই সবাই খুব সাবধানে থাকছিল, যেন দূর্গামোহন কোন কারণে অসন্তুষ্ট না হন। তাজ্জব ব্যাপার, ছোটন পর্যন্ত দুষ্টুমি করা বন্ধ করে দিল।
একদিন সন্ধ্যায় দূর্গামোহন বাবু নিজের ঘরে বসে কিছু হিসাব নিকেশ করছিলেন। একটি আমদানী রপ্তানী প্রতিষ্ঠানের সাথে তার কথা বার্তা চলছে, খুব শীগ্রি তিনি ওই কাজে নামবেন বলে স্থির করেছেন। এমন সময় লক্ষ্য করলেন, দরজার পাশে ছোটন দাঁড়িয়ে আছে, মাথা হেট করে। হাতের ইশারায় তাকে ঘরের ভিতরে ডাকলেন তিনি। তারপর তার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে জানতে চাইলেন, ছোটনের মন খারাপের কারণ কি? ছোটন খানিকক্ষণ একটু ইতস্তত করল। তারপর হাত দিয়ে বাবার হাত ধরে টানল, সে তাকে নিয়ে বাইরে যেতে চায়। দূর্গা মোহন বাবুর কাজ করতে করতে মাথা ধরে গিয়েছিল, তাই ভাবলেন, একটু বাতাস খেয়ে এলে তার ভালোই লাগবে। সুতরাং ছোটনের সাথে সাথে বাইরে এলেন তিনি। ছোটন হাঁটতে হাঁটতে তাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে এলো, যার দুই পাশে টিনের চালা ঘরে দোকানের কর্মচারীদের থাকার জায়গা, আর সামনে হল দোকানের পিছনের দেয়াল। এরপর, ছোটন বেশ হাল্কা ভাবে একটা চালা ঘরের চালের উপরে উঠল। উঠে দোকানের দেয়ালের কাছা কাছি গিয়ে দেয়াল থেকে একটা জানলার মত জায়গা খুলল। দূর্গামোহন বাবু বিস্মিত চোখে লক্ষ্য করলেন, সেই ফোকড় দিয়ে আসলে দোকানের ভিতরের এয়ার ডাক্টের ভিতর যাওয়া যায়। আর ছোটনের হাল্কা ছোট শরীরে সেটা গলে ভিতরে ঢোকাটা কোন ব্যাপারই নয়। মুহূর্তের মধ্যে সব পরিষ্কার হয়ে গেল দূর্গামোহনের কাছে। দোকানের যত ভূতের উপদ্রব, সবই আসলে ছোটনেরই এক দুষ্টু খেলা, আর কিছুই না। কিন্তু, এই কথা এখন কে বিশ্বাস করবে? সবাই হয়তো ভাববে, দূর্গামোহন বাবু ভূতের দোষ কাটানোর জন্য বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছেন। আর সে কথা যদি মানুষ বিশ্বাস করে, তাহলে ছোটনের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি ছোটনকে নিজের কাছে ডাকলেন। ছোটন এক ডাকে চলে এলো। হাল্কা আলোয় দেখলেন, ছোটনের চোখের কোণে জল। উনি সেটা নিজের হাত দিয়ে মুঝে ছোটনকে কোলে তুলে নিলেন। এরপর মৃদু স্বরে বোঝালেন, ছোটন এমনটা করা ঠিক হয় নি। এবং প্রতিজ্ঞা করালেন ছোটনকে দিয়ে যে সে আর এমনতর দুষ্টুমি করবে না। ছোটন সবই এক কথায় মেনে নিল।
পরদিন থেকে ছোটন যেন একেবারে আদর্শ ছেলে, কোন দুষ্টুমি নেই, বড়দের সব কথা এক কথায় মেনে নিচ্ছে, পড়াশুনো করছে। ছোটনের মায়ের যেন ধরে প্রাণ এলো। উনার ধারণাই হয়েছিল, ছোটনকে হয়তো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারবেন না।
ওই দিকে দূর্গামোহন বাবু মিস্ত্রি ডাকিয়ে এয়ার ডাক্টের বাইরের দরজা গুলো বেশ শক্ত করে এঁটে দিলেন যাতে ভবিষ্যতে সহজে কেউ এই দরজা খুলতে না পারে। ভূতের আসল রহস্যকি, সেটা উনি আর প্রকাশ করলেন না!
মাস খানেক পর দূর্গামোহন বাবু তার নতুন ব্যবসার কাজে এক দূরের শহরে গেলেন। নানান কাজের ভিড়ে হঠাৎ খেয়াল করলেন, মোবাইলে ব্যাটারির চার্জ প্রায় শেষের দিকে। উনার ইচ্ছা সেইদিনই নিজের শহরে ফিরে আসা, কারণ রাতে দোকানের কিছু মালিকের সাথে তার জরুরি মিটিং আছে। ব্যবসার কাজ সেরে বাসে উঠে বসে দেখেন, চার্জ শেষ হয়ে ব্যাটারিও ডেড, মোবাইলো অফ। বাড়িতে একটা ফোন করতে পারলে ভালো হত, কিন্তু কি আর করার! আশা করি মিটিং শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশী রাত হবে না, দরকার পরলে মিটিং এর আগে একটু বাসায় ঘুরে আসাও যাবে।
কিন্তু পথে বাসের টায়ার পাংচার হল। গাড়ির চাকা ঠিক করতে অনেকটা সময় গেল। তারপর মাঝে এক বাজারে বিশাল গন্ডগোল। সেখানে এক বুড়ো রাস্তা পাড় হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়েছে। তাই স্থানীয় লোকজন রাস্থা বন্ধ করে গাড়ি-বাস যা সামনে পাচ্ছে তাই ভাঙ্গছে। সেখানে প্রায় ৪-৫ ঘন্টা লাগল পুলিশের সব নিয়ন্ত্রণে এনে রাস্তা পরিষ্কার করতে। ফলে দূর্গামোহন বাবু শহরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। দোকানদারদের সাথে মিটিং এর জন্য এখনো হাতে কিছুটা সময় আছে, তবে বাসায় হয়তো যাওয়া হবে না। মিটিং এ যাবেন বলে রিক্সা ঠিক করেছেন, এমন সময় মনে হল, একটা জরুরি কাগজ মিটিং এ দেখানোর কথা, সেটা তিনি দোকানেই ফেলে এসেছেন। তাই ঠিক করলেন, খুব দ্রুত দোকানে গিয়ে কাগজটা নিয়ে মিটিং এ যাবেন।
বিপণির সামনে রিক্সা দাঁড় করিয়ে স্বর্ণালংকারের দোকানে ঢুকলেন দূর্গামোহন বাবু। সব বাক্স পেটরা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু সেই কাগজ কোথাও চোখে পড়ল না। বাধ্য হয়ে তাদের অপর দোকানটির তালা খুললেন। এদিকে মিটিং এর দেরী হয়ে যাচ্ছে, আর ফোন করে জানানোর কোন উপায় নেই। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কাজ আরো বাড়াচ্ছিলেন তিনি। বেশ বিরক্ত আর উদ্বিগ্ন হয়ে মাথা চুলকাচ্ছেন, এমন সময় ঘুলঘুলির ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, স্টিলের ড্রয়ার গুলো উপর থেকে দুই নম্বর ড্রয়ারের ভিতর একটা খয়েরী রঙের খামের ভিতর কাগজটা পাওয়া যাবে। দূর্গামোহন বাবু চমকে উঠলেন, পরক্ষণেই বুঝলেন, এটা ছোটনের গলা। গলার মধ্যে একটু রাগ দলা পাকালো তার। ছোটন তার কথা রাখে নি, কোন ভাবে সে আবার এয়ার ডাক্ট দিয়ে ঢুকে এই দোকানের ঘুলঘুলি পর্যন্ত এসেছে। না, ছোটনকে এবার কিছুটা শাসন করতেই হবে। কিন্তু তার আগে দরকার কাগজটা, মিটিং এর এতক্ষণে মিনিট দশেক দেরীও হয়ে গেছে, রাস্তায় রিক্সাওয়ালাও দাঁড় করানো। ছোটনের কথা মত খুঁজে দূর্গামোহন বাবু সেই কাগজ পেলেন। তারপর ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ছোটন, ঘরে যাও! আজকে তোমাকে শাসন করা হবে। ছোটনের তরফ থেকে কোন প্রত্যুত্তর এলো না। অবশ্য দূর্গামোহন বাবু প্রত্যুত্তরের আশায় যে বসে ছিলেন, তাও না। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে বাইরে গিয়ে দেখেন, রিক্সাওয়ালা এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে। তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে তাড়াতাড়ি মিটিং এ গেলেন। গিয়ে দেখলেন, সেখানে কেউ নেই। হয়তো দূর্গামোহন বাবুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সবাই বাসায় চলে গেছে। নিজের উপর সামান্য বিরক্ত হলেন তিনি। তারপর রিক্সাওয়ালাকে বললেন বাসায় যেতে।
বাসায় ঢুকে দেখেন, বাসায় অনেক মানুষ। সবার কেমন যেন থম থমে ভাব, কেউ কোন কথা বলছে না। এমন সময় দূর্গামোহনের স্ত্রী ঝাপিয়ে দূর্গামোহনের বুকের উপর পরল। দূর্গামোহন ভাবল, সবাই বুঝি ফোনে তাকে না পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। এদিকে তাঁর স্ত্রীর বুক ফাটা কান্না থামেই না। দূর্গামোহন কিছুটা সামলে তাকে দুই হাতে ধরে একটু দূরে সরালেন, তারপর বললেন, সরমা, কাঁদছ কেন, আমি তো এসে গেছি। স্যরি, মোবাইলের চার্জটা শেষ হয়ে গেছিল…
কিন্তু সরমা যেন কিছুই শুনতে পেলেন না, আর্তনাদ করে উঠলেন একবার ‘ছোটন’ বলে। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। আশেপাশের মানুষ ধরা ধরি করে সরমা দেবীকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল। দূর্গামোহন তখন হতবিহবল চোখে এই ঘটনার উত্তর খুঁজতে থাকলেন। তখন দূর্গামোহনের নিকট বন্ধু আসাদ দূর্গামোহনের কাছে এসে বলল, দূর্গা, ছোটন আর নেই রে। হতবাক হয়ে দূর্গামোহন তাকিয়ে রইলেন আসাদের দিকে। এ কি করে সম্ভব! আধা ঘন্টাও হয় নি তার ছোটনের সাথে আলাপ হয়েছে। এরই মাঝে কি এমন হয়ে গেল?
আসাদ সাহেব দূর্গামোহনের মুখভঙ্গি দেখে ধীরে ধীরে বললেন, আজ ছোটন স্কুলে যেতে গাড়ি নেয় নি, হেঁটে হেঁটে স্কুল থেকে ফিরছিল। সে সময় এক ড্রাইভার ফুটপাথে গাড়ি তুলে দেয়। ঘটনাস্থলেই ছোটনের মৃত্যু হয়। এটা দুপুর বারোটার ঘটনা। আপাতত ছোটনের দেহ হিমাগারে পুলিশের হেফাজতে আছে। সবাই দূর্গামোহনের জন্য অপেক্ষা করছিল, উনিই এসে পরলোকক্রিয়ার কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
দূর্গামোহন কিন্তু তখনো ঘোরের মধ্যে। তাহলে কি ঘুলঘুলির মধ্যে ছোটনের সে কন্ঠস্বর তার মনের ভ্রান্তি। নাকি স্বর্গ যাত্রার প্রাক্যালে ছেলেটা একটু এসেছিল বাবার কাছে, শেষ বিদায় নিতে, কিন্তু তার বদলে শাসন পেয়ে গেল।
এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। সেই বাণিজ্য বিতানে আর কখনো ভূতের উপদ্রব হয় নি। বিক্রি বাট্টাও বেড়েছে আগের থেকে। তবে, অনেক রাতে যদি সেই বিপণিতে যাও, দেখবে, দূর্গামোহন বসে আছেন তার প্রসাধনীর দোকানটার ঘরে। অস্ফূট স্বরে বলে যাচ্ছেন নানান কথা, সেই ঘুলঘুলির উদ্দেশ্যে। সেই কথার প্রত্যুত্তর কি আসে? তা আমাদের জানা নেই।
১২/০৩/২০২০
কলেজ স্টেশন